About Us – July 2024

রক্তাক্ত ইতিহাস, সংগ্রামের চিহ্ন

২০২৪ সালের জুলাই মাস ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ভয়াবহ এবং লজ্জাজনক অধ্যায়। মাদারীপুর শহরে জনগণের ন্যায্য দাবি, ভোটাধিকার এবং বিচারবহির্ভূত নির্যাতনের বিরুদ্ধে যখন সাধারণ মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে রাস্তায় নামে, তখনই নেমে আসে রক্তের বৃষ্টি। রাষ্ট্রীয় শক্তি যখন মানুষের কণ্ঠ রোধ করতে ব্যর্থ হয়, তখন গুলি চালায়, নির্মম নির্যাতন চালায়। শহীদ হয় অনেক নিরীহ তরুণ, ছাত্র, শ্রমজীবী মানুষ—যাদের অপরাধ ছিল, তারা সত্য বলেছিল, প্রতিবাদ করেছিল।

এই ওয়েবসাইটটি তৈরি করা হয়েছে সেইসব শহীদদের স্মরণে, সেইসব প্রতিবাদী মুহূর্তকে ধরে রাখার জন্য। আমরা বিশ্বাস করি—ইতিহাস লিখতে না পারলে, ইতিহাস মুছে যায়। “রক্ত জুলাই মাদারীপুর” শুধু একটি দিনের নাম নয়, এটি একটি প্রতিরোধের প্রতীক, একটি গণঅভ্যুত্থানের শুরু।আমাদের গ্যালারিতে রয়েছে শহীদের ছবি, আহতদের মুখ, মাদারীপুরের রাস্তায় হাজারো মানুষের প্রতিবাদের দৃশ্য। প্রতিটি ছবি, প্রতিটি শব্দ এই ইতিহাসেরই একেকটি প্রমাণপত্র।

About Us – July 2024

আন্দোলনের সূচনা ঘটে চাকরির কোটাব্যবস্থা পুনর্বহাল এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বিতর্কিত মন্তব্য ঘিরে। জুন মাসের শেষদিকে হাইকোর্ট চাকরিতে পুরনো কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের নির্দেশ দিলে তরুণদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থী সমাজ মনে করে, এতে মেধাবীদের অবমূল্যায়ন হবে, এবং রাষ্ট্রীয় চাকরিতে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর একচেটিয়া সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।

কিন্তু পুরো জাতিকে আগুনের মধ্যে ঠেলে দেয় প্রধানমন্ত্রীর সেই বচন—

“রাজাকারের সন্তানদের চাকরি লাগবে না।”

এই কথাটি দেশের লাখো তরুণ-তরুণীর হৃদয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। একটি স্বাধীন দেশে জন্ম নেওয়া নতুন প্রজন্ম, যাদের অপরাধ শুধু বংশ পরিচয়—তারা এ কথাকে দেখে রাষ্ট্রীয় বৈষম্য ও নাগরিক অধিকারের চরম অবমাননা হিসেবে। এই বক্তব্য থেকে যেন ধ্বনিত হয়—এই রাষ্ট্র সবার নয়, কিছু বিশেষ গোষ্ঠীর মালিকানায় চলছে।

ছাত্রদের ক্ষোভ দ্রুত রূপ নেয় সংঘবদ্ধ আন্দোলনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট—সর্বত্র শুরু হয় অবস্থান কর্মসূচি, মিছিল, ক্লাস বর্জন। আন্দোলনের মুলধারা তৈরিতে সক্রিয় হয় বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র প্রতিনিধিরা, এক হয়ে গড়ে উঠে “চাকরিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র ঐক্য”।

শুরুতে দাবিগুলো ছিল ৯ দফাভিত্তিক। এর মধ্যে ছিল—চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ, কোটাব্যবস্থার সংস্কার, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিচার, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি। কিন্তু ১৬ জুলাই রংপুরে শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে পুলিশের গুলিতে হত্যা, ১৭ ও ১৮ তারিখে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংস হামলা পুরো আন্দোলনের মোড় ঘুরে যায়।

ছাত্ররা, সাধারণ মানুষ, এমনকি কর্মজীবী শ্রেণিও রাজপথে নেমে আসে। শত শহীদের লাশ, হাজার হাজার আহত—সব মিলে গড়ে ওঠে এক সত্যিকারের গণঅভ্যুত্থান।

“এক দফা এক দাবি – শেখ হাসিনার পদত্যাগ চাই!”—এই দাবিই হয়ে ওঠে নতুন স্লোগান।

সারা দেশজুড়ে আন্দোলন ভয়াবহ রূপ নেয়। ঢাকার শাহবাগ, প্রেসক্লাব, পলাশী, গাবতলী, আজিমপুর, মিরপুর, উত্তরা, নীলক্ষেত—সব জায়গায় রাজপথে জনস্রোত। ইন্টারনেট বন্ধ করে আন্দোলন থামাতে চায় সরকার, ইন্টারনেট বন্ধ করে, বিদেশি সাংবাদিকদের নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু কিছুই কাজ করে না। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে জেলা থেকে উপজেলায়, শহর থেকে গ্রামে। রাজপথে গর্জে উঠে সাধারণ মানুষ—নারী, বৃদ্ধ, শিশু, কিশোর সবাই।

শহীদ সংখ্যা একসময় গোনা বন্ধ হয়ে যায়।
স্বাধীন পর্যালোচনাকারী সংস্থাগুলো মতে, পুরো জুলাই ও আগস্ট জুড়ে ২,০০০+ শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারী শহীদ হন। আহত হন দশ হাজারের বেশি। গ্রেফতার হন প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষ, গুম-নিখোঁজ হন অনেকে।

এই সময়ে সবচেয়ে সাহসী ভূমিকা পালন করে নারী শিক্ষার্থীরা। তারা প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন, বুলেটের সামনে দাঁড়ান, অথচ তাদের উপর চলে শারীরিক ও যৌন নিপীড়ন—যা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টে উঠে আসে।

এই আন্দোলনকে দমাতে সরকার যে কোনো রকম সংবিধান ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করতেও দ্বিধা করে না। যাত্রাবাড়ীতে গুলি চালিয়ে যেভাবে শিক্ষার্থীদের হত্যা করা হয়, তা অনেকের চোখে ১৯৭১ সালের গণহত্যাকেও হার মানায়। গুলিবিদ্ধ দেহগুলোর ওপর বুট পড়িয়ে পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ মিলে ‘রাষ্ট্রীয় চরমতম বর্বরতার’ দৃষ্টান্ত গড়ে তোলে।

আন্দোলন শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ ছিল না। দেশের প্রতিটি জেলা শহর, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও এর আঁচ লেগেছিল। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে, বিশেষ করে মাদারীপুর জেলা হয়ে ওঠে এই গণআন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।

মাদারীপুরে ছাত্র সমাজ, শিক্ষক, সাধারণ জনগণ এমনভাবে রাজপথে নেমে আসে যে সেটি এক নিজস্ব বিপ্লবের রূপ নেয়। পুরো জুলাই জুড়ে সেখানে চলে একের পর এক বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ, হুমকি, হামলা, গ্রেফতার, শহীদ ও সংঘর্ষের পরিক্রমা। সেখানেই রচিত হয় “রক্ত জুলাই মাদারীপুর” নামের এক অনন্য অধ্যায়—যার বর্ণনা একটি পূর্ণাঙ্গ নিবন্ধ দাবি করে।
নিশ্চয়ই, এবার শুরু করছি মাদারীপুরের রক্ত জুলাই নিয়ে বিস্তৃত, ঐতিহাসিক, তথ্যভিত্তিক ও আবেগঘন বর্ণনা—যা সরাসরি আগের অংশে যুক্ত করে পড়লে একটি ধারাবাহিক ঐতিহাসিক প্রবন্ধের মতোই পড়বে।

রক্ত জুলাই মাদারীপুর: এক জেলার আগুন হয়ে জ্বলে ওঠার ইতিহাস

বাংলাদেশের ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের জাতীয় স্রোত যেখানে ঢাকাকে কেন্দ্র করে প্রবাহিত হচ্ছিল, সেখানে দক্ষিণাঞ্চলের শান্ত, নদীবিধৌত জেলা মাদারীপুর পরিণত হয়েছিল এক অভূতপূর্ব প্রতিরোধের দুর্গে। রাজধানী থেকে শত কিলোমিটার দূরে এই জেলাকে কেউ কল্পনাও করেনি এতটা উত্তাল হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু সময়ের দর্পণে ঠিক সেখানেই রচিত হয় গণআন্দোলনের আরেকটি মুখ—” রক্ত জুলাই মাদারীপুর”।

এখানে প্রতিটি দিন ছিল এক একটি যুদ্ধক্ষেত্র। প্রতিটি ব্যানার ছিল বুলেটের বিপরীতে লড়াইয়ের প্রতীক। শহীদ দীপ্ত দে থেকে শহীদ রুমান বেপারী কিংবা শহীদ তাওহীদ সন্যামাত—তাদের রক্তে লাল হয়েছিল শকুনী লেক, মস্তফাপুরের মহাসড়ক, ডিসির ব্রিজ। এ অংশে আমরা মাদারীপুরে জুলাই মাসের প্রতিটি দিনের ঘটনাক্রম, শহীদদের তালিকা, আন্দোলনের ধরন, হামলা-হয়রানির বিবরণ এবং জনগণের অভ্যুত্থান বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি।

দাঁড়ায়। এখন আর কোনো খ্যাতি নয়—শাসন নয়, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা; ক্ষমতা নয়, জনতার অধিকার প্রতিষ্ঠা—এই নির্ভয় শপথের বিজয়ই ৫ আগস্ট ২০২৪-এর ইতিহাস।”

July 2024
Scroll to Top